ভারতের মুসলমানদের ৭৩ বছর পর বোধোদয় হলো

ভারতের মুসলমানদের ৭৩ বছর পর বোধোদয় হলো

মোঃ মিজানুর রহমান।
সহযোগী অধ্যাপক
সরকার ও রাজনীতি বিভাগ,শান্ত- মারিয়াম ইউনিভার্সিটি।
প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান
ওডেফ ফাউন্ডেশন এবং উত্তরা সিটি স্কুল এন্ড কলেজ

১৭৫৭সালের ২৩ জুন নবাব সিরাজুদ্দৌলাকে দেশীয় কুচক্রী মহল ও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির চক্রান্তের ফলে নির্মমভাবে হত্যার পর থেকে ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলমানরা বিভিন্নভাবে নির্যাতিত ও নিষ্পেষিত হতে থাকে। অবশেষে ১৯০ বছর পর ১৯৪৭ সালে দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে অর্থাৎ মুসলিম-হিন্দু এলাকার ভিত্তিতে মুসলিম অধ্যুষিত এলাকা নিয়ে হয় পাকিস্তান এবং হিন্দু অধ্যুষিত এলাকা নিয়ে হয় হিন্দুস্থান বা ভারত। এখানেও ভাগ্যের আকাশে কালো মেঘ দেখতে থাকে ভারতের মুসলিমরা। কারণ ব্রিটিশরা ডিভাইড এন্ড রুল,(ভাগ কর শাসন কর) নীতি অর্থাৎ মুসলিম ও হিন্দুদের ভাগ করে ১৯০ বছর শাসন করে তেমনি টু নেশন থিওরি এর ভিত্তিতে ভারত পাকিস্তান ভাগ হলেও এখানে ব্রিটিশরা আরো একটি রাজনীতি করেন তা হলো এখানে বলা হয় যদি কোন স্ব-শাসিত রাজ্য যদি মনে করে তারা ভারত বা পাকিস্তানে দিকে যেতে পারবেন। আর সমস্যা দেখা দেয় এখানে কারণ কাশ্মীরের জনসংখ্যা ৯৫ শতাংশ মুসলমান সেহেতু কাশ্মীর রাজ্যটিকে পাকিস্তানের পাওয়ার কথা কিন্তু সমস্যা হল কাশ্মীরের রাজা ছিলেন হরি সিং( হিন্দু) তিনি নিয়ম অনুযায়ী পাকিস্তানের পক্ষে না যেয়ে দিল্লিতে এসে ভারতের পক্ষে যোগদান করলেন। কারণ হিসেবে উল্লেখ করা যেতে পারে যে ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী ছিলেন নেহেরু গান্ধী তার বাড়ি ছিল কাশ্মীরে তাই মনে করা যেতে পারে হরি সিং এবং নেহরু-গান্ধী চক্রান্ত করে ৯৫ শতাংশ মুসলমান রাজ্য কাশ্মীর কে ভারতের দিকে নিয়ে আসে।

যদিও এ অবস্থা দেখে পাকিস্তান কাশ্মীরের বেশ কিছু এলাকা দখল করে নেয় যা আজাদ কাশ্মীর নামে পরিচিত, আর বাকি অংশ অর্থাৎ জম্মু-কাশ্মীর ভারতের নিয়ন্ত্রণে থেকে যায় তারপর থেকে আজ অব্দি জম্মু কাশ্মীরসহ ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে ভারতীয় সেনাবাহিনী, পুলিশ, আর এস এস, বজরং ও বিশ্ব হিন্দু পরিষদ কর্তৃক মুসলমান জনগোষ্ঠী বিভিন্ন ভাবে হত্যা গণধর্ষণের শিকার হয়ে আসছে। ভারতের গত দুটি জাতীয় নির্বাচনে মোদি সরকার ক্ষমতায় আসার পর এর পরিমাণ আরো বেড়ে গেছে। এখানে উল্লেখ্য যে ২০০২ সালে নরেন্দ্র মোদি গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন সময়ে গুজরাটের গোধরা রেলস্টেশনে সন্ধ্যার সময় সবরমতী ট্রেনে কে বা কারা আগুন লাগিয়ে দেয় এর ফলে ৫৭ জন রাম সেবক মারা যান, তখন মোদি সরকার উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ভোটের রাজনীতিকে মাথায় রেখে মুসলমানদের উপর দায় চাপিয়ে দেন এবং হিন্দু- মুসলিম দাঙ্গা বাঁধিয়ে দেন। ফলে গুজরাটের হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা শুরু হয় উক্ত দাঙ্গায় পুলিশের সহায়তায় আরএসএস, বজরং,ভিএইচপি বা বিশ্ব হিন্দু পরিষদ মুসলমানদের আগুনে পুড়িয়ে, জবাই করে এমনকি গর্ভবতী মহিলাদের পেট কেটে বাচ্চাদেরকে ত্রিশূলে ঝুলিয়ে রাখেন যা বর্তমান সভ্য যুগে খুবই লজ্জাকর ছিল। এটি ছিল ভোটের রাজনীতি, তখন ইউরোপ-আমেরিকাসহ অনেক রাষ্ট্র নরেন্দ্র মোদির উপর ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা করে। সেই নরেন্দ্র মোদী প্রবর্তিত আরএসএস, বজরং, বিশ্ব হিন্দু পরিষদকে কাজে লাগিয়ে দু-দুবার ভারতের প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন এবং মুসলমানদের হত্যা ও নির্যাতনের উৎসবে মেতেছেন।

কিছুদিন আগে বিজেপি সরকার বা নরেন্দ্র মোদি জম্মু-কাশ্মীর এর ৩৭০ ধারা কে রহিত করে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে নিয়ে আসছে ফলে ঐ অঞ্চলের মানুষের ন্যুনতম স্বাধীনতা বলতে কিছু নাই সেই সাথে হত্যা গুম ধর্ষণ এমনকি কয়েকজন মুখ্যমন্ত্রীকে ও গৃহবন্দী করে রাখছেন। অতি সম্প্রতি দিল্লিতে দাঙ্গা বাঁধিয়ে মোদি সরকার মুসলমানদের হত্যা ও মা-বোনদের ইজ্জত নষ্ট করছে যা খুবই লজ্জাস্কর। এছাড়াও আমরা দেখছি ভারতের উত্তর প্রদেশেসহ বিভিন্ন অঞ্চলে মুসলমানরা গরুর মাংস বহন বা ভোগ করলে মুসলিমদেরকে হত্যা করা হচ্ছে। যা মুসলিম বিশ্বের জন্য খুবই লজ্জাস্কর। এখানে আরো উল্লেখ্য যে ভারতে বাবরি মসজিদ ভেঙে যে রাম মন্দির তৈরি করলেন নরেন্দ্র মোদী যিনি বর্তমানে ভারতের সরকারপ্রধান যে অভিযোগে মসজিদ ভেঙ্গে মন্দির তৈরি করা হল সেখানে ভারতের প্রত্নতত্ত্ববিদরা রাম মন্দিরের কোনো অস্তিত্বই খুঁজে পায় নাই, নরেন্দ্র মোদী এমন একজন ব্যক্তি যিনি ছোটবেলা থেকেই ছিলেন মুসলিম বিদ্বেষী এবং ব্রিটিশদের মত তিনিও হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা বাধিয়ে ভোটের রাজনীতি করে আসছেন যা আধুনিক বিশ্বে জন্য খুবই দুঃখজনক।

আমরা দেখে আসছি ১৯৪৭ সাল থেকে বর্তমান অব্দি মুসলমানরা ভারতের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ক্ষমতায় যাওয়ার সিঁড়ি হয়ে আছে তাদের নিজস্ব কোন রাজনৈতিক প্লাটফ্রম তৈরি করতে পারে নাই যার ফলে হিন্দুরা মুসলিমদের তোষণ নীতি করে আসে। এমত অবস্থায় ভারতের মুসলমানদের নৌকার মাঝি হিসাবে হাল ধরেছেন হায়দ্রাবাদের ব্যারিস্টার আসাউদ্দিন ওয়েইসি যাকে অনেকে জিন্নাহর সাথে তুলনা করেছেন।

দীর্ঘ ৭৩ বছর যাবত দেখা গেছে যে ভারতের মুসলিমদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের জন্য কোন সরকারি কাজ করেনি। গুজরাটের যে সমস্ত এলাকা অনুন্নত সে সমস্ত অঞ্চলে মুসলমানদের বসবাসের জায়গা দেয়া হয়, দেখা যাচ্ছে একই এলাকায় পাশাপাশি হিন্দু অঞ্চলে বড় বড় অট্টালিকা এখানে বিদ্যুৎ, পানি ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছে মুসলিমরা সে সুযোগ সুবিধা পাচ্ছে না এবং এটাও দেখা যায় মুসলমানদের চিকিৎসার জন্য উন্নত হাসপাতালে যেতে দেওয়া হয় না। কলকাতাতেও দেখা যায় মুসলমানরা যে অঞ্চলে বসবাস করছে সে অঞ্চল গুলো খুবই অনুন্নত, পশ্চিমবাংলায় ৩০% মুসলমান হওয়া সত্ত্বেও সরকারি চাকরি বা অন্যান্য সুযোগ-সুবিধাতে দেখা যায় ১% মুসলমানদের অংশগ্রহণ নাই। ভারতের মুসলমানরা দীর্ঘদিন যাবত অন্য রাজনৈতিক দলের ক্ষমতায় যাওয়ার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার হয়ে আসছে অর্থাৎ মুসলিম তোষণ নীতি এখানে ব্যবহার করা হয়েছে। দেখা গেছে মুসলমানরা কখনোও কংগ্রেস, কখনো সিপিএম ,কখনো তৃণমূল কংগ্রেসসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলের রাষ্ট্রক্ষমতায় যাওয়ার পথ সুগম করে দিয়েছে। এমত অবস্থায় ভারতের মুসলমানদের অধিকার আদায় ও হিন্দুদের হাত থেকে রক্ষার জন্য হাল ধরেছেন আসাদ উদ্দিন ওয়াইসি তিনি “All India Majlls-E- Ittehadul Muslimeen (AIMIM) নামক একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেছেন এবং এই দল থেকেই বিহারে সদ্যসমাপ্ত বিধানসভা নির্বাচনে “মিম”নামক রাজনৈতিক দল থেকে পাঁচজন এমপি নির্বাচিত হয়েছেন এবং আসাদউদ্দিন ওয়াইসি তিনি নিজেও লোকসভার একজন পাঁচবারের এমপি হায়দ্রাবাদ থেকে।

এখন মিমের টার্গেট ২০২১ সালে পশ্চিমবাংলার বিধানসভা নির্বাচনে ৯০ থেকে ৯৪ জন এমপি প্রার্থী দেওয়া। কারণ পশ্চিম বাংলার যে সমস্ত অঞ্চল মুসলিম অধ্যুষিত বিশেষ করে মালদা, মুর্শিদাবাদ, দক্ষিণ ২৪. পরগনা, বীরভূম জেলাসহ বাংলাদেশ ঘেষা বিভিন্ন জায়গায় মুসলিম ভোটার সংখ্যা অনেক বেশি এবং কোন কোন জেলাতে মুসলমান ভোটার ৭০ থেকে ৮০ পার্সেন্ট এর উপরে এই সমস্ত অঞ্চল থেকে “মিম” আশা করছে ৪০ থেকে ৫০ জন বিধানসভার সদস্য নির্বাচিত হবেন যা মুসলমানের জন্য অধিকার আদায়ের পথ সুগম হবে এবং পর্যায়ক্রমে “মিম” উড়িষ্যা, ঝাড়খন্ড, তেলেঙ্গানা ও উত্তর প্রদেশসহ বিভিন্ন রাজ্যে বিধানসভা ও লোকসভা ভোটে লড়বেন বলে আশা করা যাচ্ছে। বর্তমানে দিল্লিতে যে কৃষক বিদ্রোহ চলছে এই বিদ্রোহের সাথে “মিম” একাত্মতা ঘোষণা করে তাদের খাদ্য সামগ্রীসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। ব্যারিস্টার আসাদ উদ্দিন ওয়াইসি যদিও মুসলিমদের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য উক্ত রাজনৈতিক দলটি গঠন করলেও তিনি ঘোষণা দিয়েছেন শুধু মুসলমানদের জন্য নয় দলিত শ্রেণি ও আদিবাসীদের সাথে নিয়ে জোট গঠন করে ভোটের মাঠে লড়বেন কারণ ভারতে জাত-পাত প্রথা সমস্যা প্রকট তাই তিনি শোষিত-বঞ্চিত সমস্ত শ্রেণীর মানুষদেরকে সাথে নিয়েই ভারতের মানবাধিকার রক্ষার জন্য ভারতবর্ষে কাজ করে যাবেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

About Company

Subscribe Newsletter

Sign up for our latest news & articles. We won’t give you spam mails.